রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
ডাঃ মো: আলী হাসান।।
ভর্তিটা একরকম বাধ্য হয়েই করলাম, কারণ রোগীর কষ্ট দেখে খুব খারাপ লাগছিল। ভর্তি করার পর মনে হচ্ছিল কি করা যায় কারণ এখানে যে অবস্থা তাতে এ ধরনের রোগীর জন্য কিছুই করার নাই। তখন বারবার মনে হচ্ছিল আমাদের সিনিয়রদের কথা, ওরা থাকলে আমাকে এই বিপদে পরতে হতো না। রোগীর লোকজনকে বললাম যে করেই হোক জেলা শহরে নিয়ে যান, এখানে এ রোগীর জন্য কিচ্ছু করার নাই। শুনে তার স্বামী কেঁদেই ফেললো, বললো একটা ছাগল ছিল সেটা বিক্রি করে এ পর্যন্ত এসেছি, আমার পক্ষে আর করার কিছু নাই। রাত নয়টা বাজে, শীতের রাত, জেলাসদরে যাবার রাস্তা নদীপথ, এত রাতে সেখানে যাওয়া একরকম দুরুহ ব্যাপার, কোনরকমে যাওয়া যেতে পারে ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। তাতে খরচ পড়বে অনেক যা এই রোগীর পক্ষে অসম্ভব। আর আছে পরেরদিন সকালে লঞ্চ ভোর পাঁচটায় কিন্তু সে পর্যন্ত অপেক্ষা করলে রোগীর ভোগান্তি যে কত হবে তা একমাত্র রোগীই বুঝতে পারবে। যদিও বলছিলাম নিয়ে যেতে কিন্তু নিজেও বুঝতেছিলাম বাস্তবতাটা। রোগীর লোকজন বললো স্যার মরে বাঁচে যাহয় হোক, আপনে যা পারেন করেন, আমাদের আর করার কিছু নাই।
এ ধরনের রোগী কিভাবে চিকিৎসা করতে হয় তা বই পুস্তকে অনেক পড়ে এসেছি কিন্তু বাস্তবে কখনও দেখিনি। আমাদের ওখানে একজন বেশ সিনিয়র এবং অভিজ্ঞ নার্স ছিল, বললো স্যার আপনে যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি একবার চেষ্টা করে দেখি, আপনে আমার সাথে থাকবেন, আপনেই সব করবেন, আমি আপনাকে সাহায্য করবো। আমি দেখলাম কিছু একটাতো করতেই হবে, কারণ মহিলা খুব কাতরাচ্ছিল।
আগেই বলেছিলাম এখানে একটা ওটি রুম আছে, যেখানে একটা টেবিল ছাড়া আর কিছু নাই। রাত দশটার দিকে সেই টেবিলে উঠিয়ে কাজ শুরু করলাম, শীতের রাত, মহিলার কোমড় থেকে নীচ পর্যন্ত কোন কাপড় নেই। একদিকে ব্যথা অপরদিকে শীত, মনে মনে ভাবলাম একজন মাকে স্রষ্টা এত কষ্ট করার জন্যই বানিয়েছেন! এটা একটা ডেস্ট্রাক্টিভ অপারেশন, সঙ্গত কারনেই সবকিছু বলা সমীচীন না তবে রাত দশটা থেকে শুরু করে ভোর চারটা পর্যন্ত একটানা কাজ করলাম, শেষ পর্যায়ে এসে এমন একটা জায়গায় আটকে গেলাম, সেখানে থেকে আর মোটেও এগুতে পারলাম না। চিন্তা করলাম, ভোর পাঁচটায় লঞ্চ আছে, এটা ফেইল করলে পরেরদিন ভোর পাঁচটা। যেই ভাবা সেই কাজ, আর এক মুহূর্তও আর দেরি করলাম না, রোগীর লোকজনকে বললাম আপনারা এই লঞ্চে জেলা সদরে নিয়ে যান, যাবার সময় হাতে পাঁচশ টাকা দিলাম। শহরে নিয়ে গিয়ে সেদিনই সিজার করে বাকি কাজ করে ফেললো, মহিলা বেঁচে গিয়েছিল কিন্তু মহিলা আমাদের সেই সময়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটা করুন চিত্র আমাদেক দিয়ে গিয়েছিল।চলবে…
লেখক: (শিশু বিভাগ) এর সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল।